অন্ধ ও কুঁজোর আজব কাহিনী । সেরা রূপকথার গল্প
অন্ধ ও কুঁজোর আজব কাহিনী
এক গ্রামে এক অন্ধ আর এক কুঁজো পাশাপাশি বাড়িতে বসবাস করত। অন্ধ লােকটির দু’চোখই অন্ধ ছিল। ফলে সে কিছুই দেখতে পেত না।
একদিন অন্ধের মা বলল, বাবা, তাের কাকার বাড়ি থেকে একবাটি দুধ এনে দিবি? সারাদিন উপােসের পর একটু দুধ খেতে পারলে শরীরটা সুস্থ হত।
সবার নিচে এই গল্পের ভিডিও দেওয়া আছে...
অন্ধ বলল, আমি কী করে যাব মা। | ছেলের কথা শুনে মা ভীষণ রেগে গিয়ে ছেলের গালে ঠাস করে একটা চড় মেরে বলল, তা পারবি কেন? কাজ করতে বললেই তাের যত অসুবিধা। এমন ছেলে থাকার চেয়ে না থাকা অনেক ভাল।
এই বলে অন্ধের মা রাগে গজগজ করতে করতে চলে গেল। মনের দুঃখে অন্ধ ভাবল, এ বাড়িতে থেকে লাভ কী? এই ভেবে অন্ধ বাড়ি ছেড়ে পথে বেরিয়ে পড়ল।
হাঁটতে হাঁটতে নগরের শেষ প্রান্তে নদীর তীরে এসে একসময় উপস্থিত হল। কিন্তু এখন নদী পার হবে কী করে? মনের দুঃখে অন্ধ নদীর পাড়ে। বসে পড়ল।
এমন সময় এক কুঁজোও নদীর দিকে আসছিল। অন্ধকে পাড়ে বসে। থাকতে দেখে সে সামনে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘অন্ধভাই, তুমি এখানে কী করছ? তােমার চোখে জল কেন?'
অন্ধ চোখের জল মুছতে মুছতে বলল, ‘কে? কুঁজোভাই নাকি?
কুঁজো বলল, হ্যা, তুমি এখানে বসে আছ কেন?
তখন অন্ধ তার মায়ের কথা সব তাকে বলল। চিরদিনের জন্য বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছে, তাও বলল।
সব শুনে কুঁজো বলল, আমারও একই ব্যাপার ভাই। হাত থেকে একটা গ্লাস মাটিতে পড়ে ভেঙে গেছে বলে বাবা আমাকে কী মারটাই না মারল! তাই মনের দুঃখে এই দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছি।'
কুঁজোর কথা শুনে অন্ধ করুণভাবে হেসে বলল, “ভালই হল। এবার থেকে আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে। আমি তােমাকে কাঁধে তুলে নেব। কিন্তু এখন সমস্যা হল, এই নদী পার হওয়া যায় কী করে?
কুঁজো সান্ত্বনা দিয়ে বলল, “দেখাে বন্ধু, পথে নৌকো করে ওপারে যাই, তারপর যা হয় একটা কিছু হবে।'
এই বলে কুঁজো অন্ধের হাত ধরে নৌকোয় চেপে বসল, ওপারে পৌঁছে দিয়ে মাঝি তাদের কাছে পয়সা চাইল।
পয়সার কথা শুনে কুঁজো করুণ কণ্ঠে বলল, “দেখাে বাপু, আমরা এদেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছি। আমাদের কাছে একটাও পয়সা নেই। যদি কোনওদিন আবার ফিরে আসি তবে সুদসমতে তােমার পয়সা মিটিয়ে দেব।
মাঝি লােকটি ছিল খুব ভাল। সে মনে মনে ভাবল, একজন কুঁজো অন্যজন অন্ধ, ওরা পয়সা পাবেই বা কোথায়! | মাঝির হাত থেকে ছাড়া পেয়ে দু’জনে হাঁটতে লাগল। এক সময় ক্লান্ত হয়ে অন্ধ বলল, ভাই কুঁজো, সূর্য ডুবে গেছে, তবে এখনও আলাে আছে।
তবে তাে এখন থাকতে হয় বন্ধু। এরপর অন্ধকার হয়ে গেলে আর পথ চলতে পারব না। আশেপাশে কোনও বাড়ি দেখতে পাচ্ছ?”
কুঁজো চারদিকে দেখে নিয়ে বলল, “একটা কুঁড়েঘর দেখতে পাচ্ছি।'
তবে সেখানেই চলাে। আজকের রাতটা না হয় সেখানেই কাটানাে যাক।
দু’জনে উপস্থিত হল কুঁড়েঘরের সামনে। কুঁজো চিৎকার করে ডাকতে লাগল, ভেতরে কে আছ গাে, আমরা বড় বিপদে পড়েছি।'
অন্ধ আর কুঁজোর ডাকাডাকিতে গৃহস্বামী বেরিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, কাকে চাই?
অন্ধ বলল, মহাশয়, আমরা অনেক দূর থেকে আসছি। পথশ্রমে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। অনুগ্রহ করে রাতটুকু আপনার বাড়িতে যদি আমাদের আশ্রয় দেন, তবে বিশেষ উপকার হয়। | গৃহস্বামী ছিল খুব দয়ালু। একজন অন্ধ আর একজন কুঁজোকে দেখে মনে দয়া হল। সে বলল, কিন্তু আপনারা কি আমার এই কুটিরে থাকতে পারবেন? আমরা ধােপা।
অন্ধ লজ্জিত হয়ে বলল, ‘ও-কথা কেন বলছেন, আমাদের একমাত্র পরিচয় আমরা মানুষ।
গৃহস্বামী বলল, আপনাদের যদি কোনও আপত্তি না থাকে তাহলে থাকতে পারেন।
গৃহস্বামী তাদের ভেতরে নিয়ে যাওয়া আর থাকার বন্দোবস্ত করে দিল। ভাের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অন্ধের ঘুম ভেঙে গেল। কুঁজোকে জাগিয়ে বলল, ‘ভাই, রাত কত প্রহর হল?
কুঁজো বলল, “ভাের হতে চলল।
তবে আর আমাদের এখানে থেকে লাভ কী? চলাে এবার বেরিয়ে পড়ি। ঘরে নেওয়ার মতাে কিছু আছে?
কুজো চারদিক চোখ বুলিয়ে বলল, “দুটো কাপড় আছে। অন্ধ বলল, তাই নিয়ে চলাে।'
অন্ধকার থাকতে থাকতে দু’জনে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ল। একসময় বেলা পড়ে গেল। গতদিনের মতাে তারা আবার আশ্রয় নিল এক চুনবির বাড়িতে। | পরদিন ভােরবেলা চুনরির বাড়ি ছাড়ার সময় অন্ধ বলল, 'ভাই কুজো, নিয়ে যাওয়ার মতাে কিছু আছে কী?
কুঁজো চারদিক দেখে নিয়ে বলল, চুনরি বড় কৃপণ, ঘরে কিছুই রাখেনি। শুধু একভাড় চুন পড়ে আছে।
অন্ধ বলল, ‘কোথায় যখন কী প্রয়ােজন হয়? ওই চুনটুকুই নিয়ে চলাে।
তারপর সেদিন রাতে তারা আশ্রয় নিল এক টুলির বাড়িতে। ভাের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অন্ধের ঘুম ভেঙে গেল, কুঁজোকে ঘুম থেকে তুলে বলল, ভাই, মনে হচ্ছে ভাের হয়ে গেছে। চলাে এখনই বেরিয়ে পড়ি।
ঘর ত্যাগ করার সময় কুঁজো বলল, ‘অন্ধভাই একটা ফাটা ঢােলক পড়ে আছে, নেব? | অন্ধ বলল, “নিয়ে নাও।' ফাটাঢােল নিয়ে আবার তারা যাত্রা শুরু করল।
তার পরদিন রাতে আশ্রয় নিল এক নাপিতের বাড়িতে। নাপিত অতিথিদের সমাদরে আশ্রয় দিল। পরদিন ভােরবেলা কুঁজোর ঘুম ভেঙে গেল। অন্ধকে বলল, ভাই, প্রতিদিন তুমি আমাকে ডেকে তােলাে। আজ আমার ঘুম আগে ভেঙেছে, চলাে বেরিয়ে পড়ি।
অন্ধ ঘুম থেকে উঠে বলল, এই ঘরে কী আছে? ‘একটা ভাঙা ক্ষুর। ‘নিয়ে চলাে, এখন কী দরকার হয় না হয়।
ভাের থাকতে থাকতেই দু’জনে আবার বেরিয়ে পড়ল রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে একসময় অন্ধ জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা কুঁজোভাই। আমরা কী কী জিনিস পেয়েছি?
কুঁজো থলে খুলে বলল, “দুখানা কাপড়, এক ভাঁড় চুন, একটা ফাটা ঢােলক, আর একটা ক্ষুর।'
অন্ধ বলল, ‘এগুলি যত্ন করে রেখাে।'
দু’জনে হাঁটতে হাঁটতে যখন ক্লান্ত হয়ে পড়ে তখন একটা গাছের ছায়ায় বিশ্রাম নেয়। এইভাবে একসময় রাতের অন্ধকার নেমে আসে। অন্ধ জিজ্ঞেস করল, “কুঁজোভাই, আমরা এখন কোথায় এলাম?
কুঁজো বলল, “কোনও লােকজন তাে দেখতে পাচ্ছি না, তবে সামনে একটা বিরাট বড় অট্টালিকা রয়েছে।
কুঁজো বলল, ভাই অন্ধ, এতবড় অট্টালিকায় কি আমাদের আশ্রয় মিলবে?
তুমি আমার হাত ধরে আগে নিয়ে চলাে । তারপর আমি যা জানতে চাইব তার উত্তর দেবে।'
কুঁজো অন্ধের হাত ধরে অট্টালিকায় প্রবেশ করল। প্রথমে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে অনেকবার চিৎকার করে ডাকল, কিন্তু কোনও সাড়াশব্দ পেল না। বাধ্য হয়ে দু’জনে অট্টালিকার ভেতরে প্রবেশ করল। কুঁজোর মাথা ঘুরে গেল। অবাক হয়ে চারদিকে দেখতে লাগল। | কুঁজোর কাছ থেকে কোনও সাড়াশব্দ না পেয়ে অন্ধ জিজ্ঞেস করল, কী
ব্যাপার, কী দেখছ? ভাই অন্ধ, এ আমরা কোথায় এলাম? ঘরে চারপাশে মােহর আর মণিমাণিক্য পাহাড়ের মতাে করে রাখা রয়েছে।
‘কুজোর কথা শুনে অন্ধ অবাক হয়ে বলল, তুমি কি দিনের বেলায় স্বপ্ন। দেখছ নাকি?
না গাে না, স্বপ্ন নয়! এই দেখাে মােহর।
কুঁজো একমুঠো মােহর অন্ধের হাতে দিল। আনন্দে তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে গেল। বলল, “ভাই কুঁজো, এতদিনে আমাদের দুঃখ দুল হয়েছে। ভগবান আমাদের দিকে মুখ তুলে তাকিয়েছেন।
এদিকে ওই অট্টালিকায় একদল রাক্ষস বাস করত। সারাদিন তারা বনে-বাদাড়ে নদীর ধারে ঘুরে বেড়াত। গভীর রাতে আস্তানায় ফিরে আসত।
সেদিন একটা রাক্ষস একটু তাড়াতাড়িই অট্টালিকায় ফিরে এল। অট্টালিকায় প্রবেশ করে ভাজাভুজির গন্ধ পেয়ে অবাক হয়ে রান্নাঘরের দিকে গেল। রান্নাঘরের দরজা বন্ধ দেখে জিজ্ঞেস করল, 'রান্নাঘরে কে রে...?
রান্নাঘরের দরজায় খিল তুলে দিয়ে কুঁজো আর অন্ধ আবার তৈরি করছিল। গৃহস্বামীর গলা শুনে তারা চমকে উঠল। অন্ধ ভয় কাটিয়ে ভেতর থেকেই বলল, তুই কে?
রাক্ষস এই প্রশ্নে ভীষণ রেগে গিয়ে বলল, আমি রাক্ষস।'
অন্ধ খিকখিক করে হেসে বলল, ‘ও, তুই রাক্ষস! আমি তাের বাবা খােক্কস।
খােক্কসের নাম শুনে রাক্ষসটা একটু দমে গেল। বলল, দেখি তােমরা কেমন খােক্কস? থুতু ফেলে দেখাও তাে?”
অন্ধ বলল, “আগে তুই থুতু ফেলে দেখা, তারপর আমরা ফেলব। রাক্ষস একদলা থুতু জানলা দিয়ে রান্নাঘরে ফেলল। রাক্ষসের থুতু দেখে অন্ধ চুনের ভাড় থেকে একদলা চুন বাইরে নিক্ষেপ করে বলল, এই দেখ আমাদের থুতু।
ধবধবে সাদা একদলা থুতু দেখে রাক্ষসটা ভাবল সত্যি-সত্যিই হয়তাে তাদের বাবা খােক্কস এসেছে।
সে তখন নিশ্চিন্ত হওয়ার জন্য বলল, “দেখি তােমাদের লেজ। কেমন। বড় আর শক্তি। অন্ধ ঢােলক বাজাবার বেতের লিকলিকে লাঠিটা জানলা দিয়ে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, এই আমাদের লেজ। রাক্ষস লেজ ভেবে লাঠিটাকে কামড়াতে লাগল। একসময় ক্লান্ত হয়ে বেতের লাঠিটাকে ছেড়ে দিল।
তখন অন্ধ বলল, এবার তাের লেজটা বাড়িয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে তারা ক্ষুর দিয়ে রাক্ষসের লেজটা কেটে দিল। “ওরে বাবা গাে' বলে চিৎকার । করতে করতে অট্টালিকা থেকে পালিয়ে গেল রাক্ষসটা ।
রাক্ষসটা পালিয়ে গেলে অন্ধ বলল, “ভাই কুঁজো, এখানে থাকা আর ঠিক হবে না। চলাে এক্ষুনি এখান থেকে পালিয়ে যাই। হয়তাে রাক্ষসটা
তাদের দলবল নিয়ে আবার ফিরে আসবে। তখন আর তাদের হাত থেকে নিস্তার নেই।
কিন্তু ভাই এতসব মােহর, মণিমাণিক্য ফেলে চলে যাবে?
কুঁজোর কথায় অন্ধ বলল, ‘তা কেন, ধােপার ওই দুটো কাপড়েরর মধ্যে যত পারাে মােহর আর মণিমাণিক্য বেঁধে নাও।
ধােপার দুটো কাপড়েরর মধ্যে কুঁজো যতটা পারে মণিমাণিক্য বেঁধে নিল। তারপর তারা অট্টালিকা ত্যাগ করে আবার যাত্রা শুরু করল। যে পথে অট্টালিকায় প্রবেশ করেছিল সে পথে গেল না, অন্য পথ ধরে ওরা উর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে লাগল। অন্ধের জন্যই তাদের দেরি হতে লাগল। কুঁজো অন্ধের হাত ধরে এগিয়ি নিয়ে যাচ্ছে। | অনেকটা পথ যাওয়ার পর ওরা দাঁড়িয়ে পড়ল। শুনতে পেল মেঘের গর্জনের মতাে রাক্ষসদের ভয়ঙ্কর চিৎকার। এই পথেই তারা আসছে।
কুঁজো থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে অন্ধকে বলল, ‘ভায়া, এবার কী হবে? ওরা যে আমাদের গিলে খাবে।
অন্ধ বলল, এত ঘাবড়ালে কি চলে? আমি যা জিজ্ঞেস করছি তার উত্তর দাও। আশেপাশে কোনও বড় গাছ আছে?
কুঁজো বলল, “একটাই মাত্র তালগাছ আছে।
অন্ধ প্রফুল্ল চিত্তে বলল, চলাে আমরা গাছের ওপর উঠে বসি তাই বলে তারা দু’জন তাড়াতাড়ি গাছের ওপর উঠে বসল।
এদিকে রাক্ষসের দল তাদের খুঁজতে খুঁজতে তাল গাছের নীচে হাজির হল। তালগাছের ওপরে কুঁজো, অন্ধের গলা জড়িয়ে ধরে কাঁপতে কাঁপতে বলল, ভায়া, ওরা গাছের নীচে এসে পড়েছে। এবার কী হবে?
অন্ধ সান্ত্বনা দিয়ে বলল, 'ভয় পাওয়া কিছু নেই। রাক্ষসেরা তালগাছে চড়তে পারে না।
রাক্ষসের দলে সেই লেজকাটা রাক্ষসটিও ছিল। হঠাৎ সে দেখতে পেল গাছের ওপর দু’জন জড়ােসড়াে হয়ে বসে আছে, সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে দলপতিতে বলল, “ওই তালগাছের ওপর খােক্কস দটো বসে আছে।
দলপতি তখন চিল্কার করে বলল, “আয় বেটা, গাছের নীচে নেমে আয়। তােরা কেমন খােক্কস, দেখি একবার।
অন্ধ খিকখিক করে হেসে বলল, যদি ক্ষমতা থাকে তাে গাছের ওপরে উঠে আয় ।
রাক্ষসের দল সম্যায় পড়ে গেল। লেজকাটা রাক্ষটি রাগে ক্ষোভে বলল, আমি তালগাছ ধরে নীচে বসছি। তােমরা এক-এক করে আমার কাঁধে চড়ে বােসো। দলপতি ভেবে দেখল প্রস্তাবটা মন্দ নয়। সঙ্গে সঙ্গে সে বলল, “সেই ভাল। তােমরা একে অপরের কাঁধে চড়ে খােক্কস দুটিকে নীচে নামিয়ে আনাে।'
লেজকাটা রাক্ষসের কাধে লাফিয়ে এক রাক্ষস উঠে গেল। তার কাঁধে আরেক রাক্ষস। এইভাবে ধীরে ধীরে তারা ওপরের উঠতে লাগল।
এদিকে রাক্ষসদের কাণ্ড দেখে কুঁজো ভয়ে অন্ধের গলা জড়িয়ে ধরে বলল, ভায়া, এবার কী হবে?
রাক্ষসেরা যে একে অপরের কাঁধে চড়ে ক্রমাগত ওপরে উঠে আসছে!' | অন্ধ বিরক্ত হয়ে বলল, আঃ ফ্যাচ ফ্যা্চ করছ কেন?
যা বলছি মন দিয়ে শােনাে, যখন দেখবে আর একটা রাক্ষস কাঁধে উঠলেই আমাদের ধরতে পারবে তখন আমার চুল টানবে। এই বলে অন্ধ তালগাছ থেকে একটা তাল ছিড়ে তার মধ্যে চুন মাখাতে লাগল।
এদিকে আর একটা রাক্ষস কাধে উঠলেই তাদের ধর ফেলতে পারবে। তখন কুঁজো অন্ধের চুল ধরে জোরে জোরে টান দিল।
আচমকা এত জোরে টান দেওয়ায় অন্ধ চিৎকার করে বলল, এত জোরে টান দিলি কেন? তােকে মজা দেখাচ্ছি।' এই বলে সেই চুনমাখা তালটা সজোরে নিক্ষে করল মাটিতে।
নীচের লেজকাটা রাক্ষসটা ভাবল-খােক্কস হয়তাে ভীষণ রেগে গেছে। সাদা তালটা দেখে সে আরও বেশি ভয় পেয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে পড়ি কি মরি করে কাধ সরিয়ে দে ছুট, ব্যস আর যায় কোথায়?
তালগাছের মতাে হুড়মুড় করে রাক্ষসের দল মাটিতে পড়ল। দলপতি চিৎকার করে বলতে লাগল, যদি প্রাণ বাঁচাতে হয় তবে খােক্কসদের হাতের বাইরে চলে যাও।' এই বলে দলপতি পেছন ঘুরে উধ্বশ্বাসে ছুটতে লাগল।
রাক্ষসের দল পালিয়ে গেলে অন্ধ আর কুঁজো গাছ থেকে নেমে পড়ল। একসয় তারা পৌছে গেল সেই নদীর ধারে। কুঁজো নদীর তীরে বাঁধা অবস্থায় একটা নৌকো দেখে আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে বলল, ভায়া, সেই মাঝি নৌকো নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, ভালই হল। | কুঁজো আর অন্ধ নৌকোর সামনে গিয়ে মাঝির হাতে দুটি মােহর দিয়ে বলল, আমাদের চিনতে পারছ?
মাঝি একগাল হেসে বলল, ‘চিনতে পারব না! তােমরা এত টাকা দিচ্ছ। কেন? আমি তাে মাত্র দু' পয়সা পাব।'
অন্ধ বলল, এই সামান্য ক'টা টাকা তােমাকে উপহার দিলাম। সেদিন বিপদে তুমিই একমাত্র আমাদের সাহায্য করেছিলেন। এখন তুমি আমাদের এক নতুন জায়গায় পৌছে দাও, যেখানে প্রাণের অস্থিত্ব নেই, শুধু আমি আমার বন্ধু কুঁজো থাকব। মাঝি তাদের এক মরুভূমিতে নামিয়ে বিদায় নিল।
মরুভূমিতে এসে অন্ধ কুঁজোকে বলল, “এসাে, আমরা একটা জায়গায় বসে মােহর আর মণিমুক্তো গুলাে ভাগ করি।
অন্ধ চোখে দেখতে পায় না। তাই কুঁজো মােহর আর মণিমুক্তোগুলাে দুটো ভাগে ভাগ করল। একটা ভাগে বেশি মণিমুক্তো রেখে অন্ধকে বলল, ভাই অন্ধ, সমান ভাগে দুটো ভাগ করেছি, এবার তােমার যে ভাগ ইচ্ছে নাও।' অন্ধ হাত দিয়ে বেশি ভাগটা দেখিয়ে বলল, “এটা নেব।'
কুঁজো বেগতিক দেখে বলল, ভাই ভাগাভাগি ঠিক হয়নি, আর এবার ভাগ করি। এইভাবে বারবার কুঁজো দু'ভাগে ভাগ করতে লাগল। এক ভাগে বেশি আর অন্য ভাগে কম। প্রতিবাই অন্ধ বেশি ভাগটা দেখিয়ে বলল, এই ভাগটা আমি নেব।'
এক সময় কুঁজো রেগে গিয়ে একমুটো বালি অন্ধে চোখে চুড়ে দিয়ে বলল, “কোনও কিছুই তােকে দেব না। যা কিছু পেয়েছিস সব আমার জন্য, আমি দেখতে পাই, সেইজন্য।
অন্ধ দু’হাতে চোখ ঢেকে ফেলল। তার দু'চোখ বেয়ে জল জড়িয়ে পড়তে লাগল। একটু পরে চোখ থেকে হাত সরিয়ে নিল। কী আশ্চর্য, এখন তাে সে সবকিছুই দেখতে পাচ্ছে। অন্ধের চোখ ভাল হয়ে গেছে, সঙ্গে সঙ্গে সে চিৎকার করে লাফিয়ে উঠে কুঁজোর পিঠে এক লাথি কষিয়ে বলল, হতভাগা আমি তাের সঙ্গে ছিলাম বলে আমার বুদ্ধির জোরেই ফিরে এসেছি, আর কিনা আমাকেই...
কুঁজোর পিঠে লাথি মারার সঙ্গে সঙ্গেই পিঠের কুঁজ অদৃশ্য হয়ে সাধারণ মানুষের মতাে হয়ে গেল। সে তখন চিৎকার করে বলল, ভায়া তুমি দেখতে পাচ্ছ? এই দেখ আমার পিঠেও আর কুঁজ নেই।
অন্ধ দেখল, সত্যি-সত্যিই তার পিঠের কুঁজটা তাে আর নেই।
তখন কুঁজো অন্ধে হাত ধরে বলল, ভাই, ভালই হল, ঈশ্বর যা করেন। মঙ্গলের জন্যই করেন। বিবাদ না হলে তুমিও তােমার চোখ ফিরে পেতে আর আমারও কুঁজ ঠিক হত না।
তারপর দুই বন্ধু সমস্ত মণিমুক্তো সমান দুটো ভাগে ভাগ করে নিয়ে দেশে ফিরে এল। তাদের আর কোনও দুঃখকষ্ট রইল না।
=== ০ ===
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
0 মন্তব্যসমূহ