নকশা ও আমলসমূহের দর্শন ও ক্রিয়া
নকশা ও আমলসমূহের দর্শন ও ক্রিয়া
আমাদের ছােট অন্তরদৃষ্টি দ্বারা উপলব্ধি করতে পারি বা না-ই পারি এবং সীমিত জ্ঞানে বােধগম্য হােক বা না হােক এই কথা সর্বজন বিধিত ও স্বীকৃত যে, বিশ্ব চরাচরে প্রত্যেকটি কণা অনুকণার সামান্য হতে সামান্যতর নড়াচড়া অথবা কাজের দ্বারা কিছু না কিছু পরিবর্তন অবশ্যই সৃষ্টি হয়। তার কাজ বা নড়াচড়া গবেষণা বা ধারণা ভিত্তিক হােক, বস্তুগত বা আধ্যাত্মিক হােক এবং জড় বা রূহানী হােক সেই পরিবর্তনের ক্রিয়া কম বা বেশী অথবা ভাল বা মন্দ অবশ্যই হবে। হালকা হতে হালকাতম বায়ু প্রবাহে ধূলা-বালি বা খড়-কুটা অথবা কাগজের টুকরাকে এক স্থান হতে অন্য স্থানে উড়ায়ে নিক্ষেপ করে। দুর্বল পিপিলিকার নড়াচড়ায় উহাদের পায়ের নীচে জমীনের বুকে চিহ্ন সৃষ্টি করে। মানুষ ও পশু-পাখি তথা প্রাণীকূলের শব্দের আঘাতে বায়ুমণ্ডলের ইথরে থরথর কম্পন সৃষ্টি হয়ে পরিবর্তন সৃষ্টি করে। এই চিন্তাধারার আলােকে বলা যায় যে, কোন নকশা বা আমালিয়াতের প্রকাশ্য অর্থহীন যােগাযােগ এবং বােধগম্যহীন শব্দ ও সংখ্যাসমূহ কোন মানুষ মুখে উচ্চারণ করে অথবা কাগজে লিখে নিজের খেয়ালে কোন কাজে ব্যবহার করে উহা সৃষ্টি জগতের কোন না কোন বস্তুতে কিছু না কিছু পরিবর্তন ঘটাতে পারে। আর এই পরিবর্তনের নামই হল আছর বা ক্রিয়া এবং ঐ আছর বা ক্রিয়া সৃষ্টি করাই আমেলের শেষ উদ্দেশ্য হয়ে থাকে। আছর বা পরিবর্তন সৃষ্টি করার জন্য রূহানিয়াতের আলেমগণ রূহানীভাবে কিছু সংখ্যক দোয়া অথবা আমালিয়াত বিশেষ আকারে সাজিয়ে দিয়েছেন। যেগুলিকে নকশা ও আমালিয়াত অথবা চিল্লা অথবা তাবিজ নামে অভিহিত করা হয়। সেইগুলির অর্থ বা আমলের তরতীব অথবা কারণসমূহ আমাদের বােধগম্য হােক বা না হােক। কেননা রূহানী বিষয় উপলব্ধি করা সহজ কাজ নয়। সাধারণ ও স্থূল বুদ্ধি এবং সীমিত জ্ঞানী লােকের বিষয় তাে দূরের কথা, বড় বড় জ্ঞানী লােকের জ্ঞানও এই ক্ষেত্রে হিমশিম খায়। রূহানী বিষয় উপলব্ধি করা রূহানী আলেমগণেরই কাজ। এখানে একটি প্রশ্ন
উত্থাপন হতে পারে মানব জাতির প্রতি সমবেদনা প্রকাশক রূহানী আলেমগণের অবশ্য কর্তব্য ছিল বর্ণিত বিষয়ে আল্লাহর বান্দাগণের জন্য এমন স্পষ্ট স বােধগম্য নিয়ম পদ্ধতি প্রণয়ন করা যা স্থূল অপেক্ষা অধিক স্থূল জ্ঞানসম্পন্ন মে বুঝতে পারে এবং উপকৃত হতে পারে বা তার নেকীও তারা পেতে পারে। তারা এই বিষয়টি জটিল করে কেন লিখলেন, সহজ করে কেন লিখলেন না?
এই প্রশ্ন উত্থাপনের পূর্বেই সাধারণ মানুষের চরিত্র সম্পর্কে গভীর পর্যালো করা আবশ্যক। আমরা দেখছি প্রত্যেক যুগে দেশ ও সম্প্রদায়ের আত্মস্বার্থ রক্ষা প্রবনতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সত্যের সাধনা ও অন্বেষণের পরিবর্তে অসত্যের সাধনা এর অন্যকে ক্ষতি করার প্রবৃত্তি সর্বদা আঁকড়ে ধরছে। স্বীয় নগণ্য স্বার্থ রক্ষার জন অপরের বড় ধরনের ক্ষতিসাধন করার বিষয়টি সর্বসাধারণের স্বভাবে পরিণত হয়েছে। এইসব লােকের আপাদমস্তক অত্যাচার, অবিচার ও স্বার্থপরতার অন্ধকারে ডুবে রয়েছে। নকশা ও আমালিয়াতের ইলম যদি স্পষ্ট ও সহজ বােধগম্য করে দেওয়া হতাে তাহলে ইহজগতে শান্তি ও নিরাপদে জীবন-যাপন করার কল্পনাও করা যেত না। কেননা রূহানীয়াতের প্রভাব জড় পদার্থের প্রভাবের উপর সর্বদা প্রাধান্য রয়েছে এবং কেয়ামত পর্যন্ত থাকবে। দ্বিতীয়তঃ মূল্যহীন বস্তুর কোন আদর নেই। যদি এই বিদ্যা সর্বসাধারণ বিনা পরিশ্রমে অর্জন করতে পারত তাহলে তার কোন মূল্যায়ন হতাে না এবং পাত্রে ও অপাত্রে উহা বিনা দ্বিধায় ব্যবহার করতাে। ইহা ব্যতীত এই বিদ্যা কঠিন ও জটিল করার বিশেষ কারণ হল মানুষকে পরিশ্রমী, সাহসী, ধৈর্যশীল ও দৃঢ় প্রতিজ্ঞা ইত্যাদি গুণে অভ্যস্ত করা। যাতে তারা জীবনের টানা হেঁচড়ার সমস্ত স্তরে বিজয়ী হয়ে মনযিলে মকছুদে পৌছতে পারে এবং তারাই এই বিদ্যার ময়দানে প্রবেশ করবেন যারা আল্লাহর সৃষ্টিকে উপকার করার যােগ্যতা রাখেন এবং আত্মস্বার্থ ও আত্মগরজী হতে পবিত্র থাকেন ।
বর্তমান যুগের মানুষের মধ্যে একটি সাধারণ ধারণার প্রতি লক্ষ্য করা উচিত। সাধারণ মানুষ ব্যতীত অনেক বুদ্ধিমান লােকও নকশা ও আমালিয়াতের বিষয় বা বিদ্যাকে শুধু একটি ভান বা কাল্পনিক বিষয় ধারণা করে পাপী হয় এবং এই সমস্ত লােক তারাই যারা আমালিয়াত ও নকশা ব্যবহার করে কোন উপকার পান নাই। যাদের মস্তিস্ক জড় পদার্থের শিক্ষার দ্বারা অকেজ হয়ে গিয়েছে যে, রূহানীয়াত বা আধ্যাত্মিকতার নামও শুনতে পারে না। বরং সম্পূর্ণ রূহানীয়াতকে অবিশ্বাস করে। কুদরতী ছহীফাহ রূহানীয়াতে অবিশ্বাসীদেরকে ডেকে ডেকে প্রশ্নসমূহের উত্তর
দিতেছে। কিন্তু তারা ضم بکۂ عني فهم لا يزجعون আয়াতের প্রতীক সেজে রয়েছে। অর্থাৎ তারা বধির, মূর্খ ও অন্ধ। সুতরাং তারা সত্যের দিকে প্রত্যাবর্তন করবে না। এই সমস্ত লােক বিশ্ব কারখানা এবং আল্লাহর কুদরতসমূহ গবেষণার দৃষ্টিতে দর্শন করে না এবং মহান আল্লাহর প্রাত্যহিক অমূল্য আহ্বানের প্রতি তারা কর্ণপাত করে না। ঐ সকল অবিশ্বাসীদের প্রশ্নের জওয়াব দেওয়া এবং তাদেরকে বুঝানাে সংক্ষিপ্ত আলােচনায় আমাদের উদ্দেশ্য নয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, একজন অজ্ঞ কাঠমিস্ত্রী ভােতা অস্ত্র নিয়ে পাকা কাঠের চৌকাঠ প্রস্তুত করার জন্য বসল অথবা কোন এক অজ্ঞ পথিক পূর্ব দিকে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পশ্চিমমুখী হয়ে রওয়ানা করল এবং গন্তব্য স্থানের পথ বা ঠিকানা কারাে নিকট জিজ্ঞাসা করল না। যদি জিজ্ঞাসা করেও থাকে তবে নিজের ন্যায় একজন অজ্ঞ লােকের নিকট জিজ্ঞাসা করছে। এমতাবস্থায় ঐ পথিক তার গন্তব্য স্থানে কি পৌছে যাবে? অথবা সেই কাঠমিস্ত্রী ভােতা অস্ত্র দিয়ে উত্তম চৌকাঠ তৈরি করতে কি পারবে? তা কখনাে সম্ভব নয়। বরং মুসাফির গন্তব্য স্থান হতে আরাে দূরে সরে যাবে এবং সফরের কষ্টই পাবে। অন্যদিকে অজ্ঞ মিস্ত্রী শুধু কাঠই নষ্ট করবে না এমনকি অস্ত্রগুলােও খারাপ হয়ে যাবে এবং অজ্ঞ মিস্ত্রী খারাপ অস্ত্র দ্বারা কাজ করে নিজেই আহত হবে। অতএব যখন প্রকাশ্য জড় পদার্থের কাজসমূহে অজ্ঞতা ও উপযুক্ত হাতিয়ার না হলে একজন পথিক পথ ভুলে যায় এবং মিস্ত্রীর কাজ খারাপ হয়। তখন রূহানী কাজসমূহে অজ্ঞ ব্যক্তি পথভ্রষ্ট হয়ে অকৃতকার্য ও ক্ষতিগ্রস্ত হবে ইহা স্বাভাবিক ব্যাপার।
এমতাবস্থায় আমাদের বুঝে আসে না ঐ সকল লােক যারা পথ প্রদর্শক ব্যতীত এবং নিয়ম-কানুন না জেনে শুনে রূহানীয়াতের ময়দানে অবতীর্ণ হয় এবং অকৃতকার্য হয়ে সময় অপচয় করে ক্ষতিগ্রস্ত হয় আর প্রতিবেশীদের তিরষ্কার শুনে শেষ পর্যন্ত এই ইলমের প্রতি অনীহা এবং নকশা ও আমালিয়াতের ইলেমকে বেহুদা ও বেকার বলতে বাধ্য হয়। এসব লােক সম্পর্কে আমাদের কিছুই বলার নেই। তারা নিজেরাই বুঝে নিবে তাদের অভিযােগের কতটুকু গুরুত্ব আছে।
যেরূপ প্রত্যেক শব্দের মধ্যে তার অর্থ নিহিত থাকে এবং একাধিক শব্দ যথাস্থানে ধারাবাহিক ভাবে সাজালে একটি পূর্ণ বাক্য গঠিত হয় এবং উহা দ্বারা একটি উদ্দেশ্য বুঝা যায় বা তার কোন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় ঠিক সেইভাবে নকশা ও আমালিয়াতের প্রকাশ্য অর্থহীন এবং বােধগম্যহীন শব্দসমূহের মধ্যেও কোন বিশেষ অর্থ এবং ক্রিয়া থাকতে পারে। যদি সেগুলিকে স্থান ও মহল অনুযায়ী শব্দের সাজায়ে ব্যবহার করা হয় তাহলে সেগুলাে উহাদের ফলাফল ও প্রতিক্রিয়া , করবে। এই ইলম সম্পূর্ণরূপে আত্মার পবিত্রতা, কলবের একনিষ্ঠতা পরহেজগারীর উপর ভিত্তিশীল। কলবের একনিষ্ঠতা এমন এক বস্তু যা সমস্ত ক্রিয়াশীল জড় বা রূহানী বস্তুসমূহের উপর প্রভাব বিস্তারে সর্বদা অগ্রণী ভূমিকা রাখে।
যেমন- মেসমেরিজিয়ামের বিদ্যা যা এই ইলমের সামান্য অংশ শুধু কলমে একনিষ্ঠতার মধ্যে সীমাবদ্ধ। একজন মেসমেরিজিয়াম কর্মী শত শত জ্ঞান হরণকা কাজ করতে পারে। এমনকি একনিষ্ঠ অন্তর দ্বারা নদীসমূহের পানি চলাচল বন্ধ করে দেওয়া যেতে পারে, পর্বত পর্যন্ত স্থানান্তর করা যায় এবং মানুষের মন আকর্ষণ করে বাধ্যগত করা যায়। কলবের শক্তি বুঝার জন্য একটি সামান্য দৃষ্টান্ত হল- একজন মানুষ যার মনে কোন ভয়ভীতি নেই যখন সে হাকিমের সম্মুখে বিচারালয়ে প্রবেশ করে, প্রকাশ্যে কোন চাপ না থাকলেও তার অন্তরে এমনিতেই ভয়ের সঞ্চার হয়। হাকিমের সত্তাগত প্রভাব ও ক্ষমতার কারণে প্রাণে ভীতির সঞ্চার হয় না বরং ভীত হওয়ার কারণ সেই ধারণা যা সর্বদা বিচার কক্ষে চালু ও বিদ্যমান থাকে। কেননা ঐ হাকিমের সাথে বিচার কক্ষের বাহিরে যখন সাক্ষাৎ হয় তখন প্রাণ তেমন ভীত হয় না ।
নকশা ও আমালিয়াতের রূহানী বিদ্যার মধ্যেও এই কলবের শক্তি বিদ্যমান যা সমস্ত কাজে প্রভাব সৃষ্টি করে ফলাফল প্রকাশ করে। খারাপ ধারণা পােষণকারীদের অকৃতকার্য হওয়া এবং তাদের আমল ও দোয়া ক্রিয়াশীল না হওয়ার আর একটি কারণ হল তাদের আমলসমূহ নিঃস্বার্থ হয় না।
নিয়ত অনুযায়ী আমলের ফল হয়। ইহা একটি প্রসিদ্ধ বাণী। আশ্চর্যের বিষয় হল যে ব্যক্তির খানা-পিনা, কথা-বার্তা, চাল-চলন, পােশাক, বিছানাপত্র, শয়ন জাগরণ, শরীরের চামড়া, হাড়, মাংস, রক্তের প্রতিটি কণা অনুকণায় হারাম খাদ্য শামিল থাকে অথবা দিলে সর্বদা বদ নিয়ত থাকে সেই ব্যক্তির দোয়া অথবা আমল বা নকশা কিভাবে ক্রিয়াশীল হবে? অথচ আমালিয়াতের আমেলের জন্য সত্য কথা বলা, হালাল খাদ্য খাওয়া ও নিঃস্বার্থ কাজ করা প্রধান শর্ত। ইহা ব্যতীত সমস্ত আমল ও তদবীর বেহুদা অনর্থক অকেজো হয়ে থাকে। আমালিয়াতের নিয়ম পদ্ধতি এবং নির্দেশনা ও মূলনীতি সম্পর্কে বর্ণনা করা হচ্ছে যাতে আমালিয়াতের আগ্রহীগণ।
ঐ অনুযায়ী আমল করে উপকৃত হতে পারেন। এই ইলেমকে যারা অস্বীকার করে তাদের প্রতি আহ্বান করছি তারা যে নিয়ম-কানুনের অধীনে শর্তসমূহ পালন ক একবার নকশা আমালিয়াত ব্যবহার দ্বারা পরীক্ষা করেন এবং আমলের পর বলবেন তাদের অভিযােগ ও অস্বীকৃতি কতটুকু সত্য ও বাস্তব।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
0 মন্তব্যসমূহ