মজার মজার রুপকথার গল্প । দার্দেনি ও আবুল কাসেমের পুনর্মিলন

 দার্দেনি ও আবুল কাসেমের পুনর্মিলন

আবুল কাসেম তীরবেগে ঘৌড়া ছুটিয়ে কয়েকদিনের মধ্যেই বোগদাদে পৌছোলেন। আবুল কাসেমের আশা ছিল, বোগদাদের যে বণিককে তিনি আতিথ্য দ্বারা তুষ্ট করেছিলেন সেই বণিকের কাছে এই বিপদে সাহায্য পাওয়া যাবে। কিন্তু বোগদাদের পল্লীতে অনেক খুঁজেও তিনি সেই বণিকের কোনো সন্ধান পেলেন না। কয়েকদিন অবিশ্রান্ত খোঁজাখুঁজি করে খুব পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছেন আবুল কাসেম। এখন একটু বিশ্রাম চাই। বিশ্রামের উদ্দেশ্যে তিনি এক বিশাল প্রাসাদের বিপরীত দিকে এক গাছতলায় বসলেন। সেখানে বসে নরম ঘাসের উপর দেহটিকে এলিয়ে দেবার উদ্যেগ করছেন আবুল কাসেম, এমন সময় তিনি দেখতে পেলেন ঐ প্রাসাদের জানালায় তাঁরই প্রদত্ত অফুরন্ত সুরাপাত্র-বাহক বালকটি বসে আছে। বালকটিও দেখতে পেয়েছে তার পূর্বতন মনিবকে। সে তখন ছুটে গিয়ে বাদশাহ হারুণ-অল-রশীদকে এ সংবাদ জানালো।

বাদশাহ প্রথমে তার কথা বিশ্বাসই করেননি। কিন্তু ব্যাপারটা কি জানবার জন্য তিনি একজন প্রহরীকে পাঠালেন বালকের সঙ্গে। বালক বাইরে এসে আবুল কাসেমের পায়ে লুটিয়ে পড়ে বলল—প্রভু, মহামান্য বাদশাহ আপনার দর্শনপ্রার্থী। আপনি দয়া করে আমাদের সঙ্গে আসুন।

আবুল কাসেম জিজ্ঞাসা করলেন তুমি এখানে বাদশাহের প্রাসাদে কি করে এলে?

বালক বলল–আপনি যাকে বণিক ভেবে আদর-যত্ন করেছিলেন তিনি বণিক নন—স্বয়ং বাদশাহ হারুণ-অল-রশীদ। বণিকের ছদ্মবেশে তিনি আপনার প্রাসাদে গিয়েছিলেন।

আবুল কাসেম একথা শুনে আনন্দে বিহ্বল হয়ে পড়লেন। স্বয়ং বাদশাহ তাঁর গৃহে আতিথ্য গ্রহণ করেছেন বলে নিজেকে ধন্য মনে করলেন আবুল কাসেম । তিনি তৎক্ষণাৎ উপস্থিত হলেন বাদশাহের কাছে। বাদশাহ তাঁকে সমাদর করে পাশে বসালেন। তারপর জিজ্ঞাসা করলেন আপনার এমন দশা কেন বন্ধু? কি হয়েছে?

আবুল কাসেম তখন সমস্ত ঘটনার কথা সবিস্তরে বললেন বাদশাহকে। তা শুনে বাদশাহ বললেন আমিও এমন ধরনের কিছু ঘটেছে বলে আশংকা করেছিলাম। সেজন্য আমি উজির জাফরকে বিরাট সৈন্যদল নিয়ে সুলতান ও তার উজিরকে বেঁধে আনার জন্য পাঠিয়েছি। জাফর শয়তান দুটোকে নিয়ে এলে আমি তাদের কঠোর শাস্তি দেবো।

এরপর আবুল কাসেমকে স্নান করিয়ে উত্তম বেশভূষা পরিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো অন্দরমহলে।

বেগম জোবেদী তখন রত্ন-সিংহাসনে বসে সখীদের গান-বাজনা শুনছিলেন। সখীরা চারপাশে ঘিরে রয়েছে—মাঝখানে অপূর্ব রূপ লাবণ্যময়ী এক নারী মধুর কণ্ঠে গান ধরেছে। এমন সময় আবুল কাসেমকে সঙ্গে নিয়ে সেই কক্ষে প্রবেশ করলেন বাদশাহ।

বাদশাহ বললেন—বেগম, ইনিই আমার সেই বন্ধু আবুল কাসেম— যাঁর আতিথ্যে আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম এবং যিনি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ দাতা।

কাসেম সেই মুহূর্তে বেগমকে ভূলুণ্ঠিত হয়ে সালাম করলেন। ঠিক এই সময় এমন এক ঘটনা ঘটলো যাতে উপস্থিত সকলে বিস্ময় বোধ করলেন। মধ্যস্থলের সেই অপূর্ব রূপলাবণ্যময়ী নারী অকস্মাৎ অজ্ঞান হয়ে মেঝেতে পড়ে গেল। আবুল কাসেম তখন সেই নারীর দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করে স্থির হয়ে গেলেন। তাঁর দু'চোখে ঝরতে লাগলো অশ্রু। তিনি নিজেকে আর সংযত রাখতে পারলেন না – তৎক্ষণাৎ ছুটে গিয়ে ঐ নারীর মাথাটা নিজের কোলে তুলে নিলেন।

বাদশাহ অবাক হয়ে গেলেন আবুল কাসেমের এমন হঠকারিতাপূর্ণ ব্যবহারে। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন আবুল কাসেম, আপনি কি এই নারীকে পূর্বে চিনতেন?

উত্তরে আবুল কাসেম বললেন—জাঁহাপনা, এ-ই আমরা হারিয়ে-যাওয়া

প্রিয়তমা। এরই নাম দার্দেনি যার বিরহে দিনরাত আমি অসহনীয় দুঃখ নিয়ে কাল কাটাচ্ছি। কিছুক্ষণ পরে জ্ঞান ফিরলে আবুল কাসেম জিজ্ঞাসা করলেন তুমি

এখানে কিভাবে এলে দার্দেনি?

দার্দেনি বলল আমি সমুদ্রজলে ভাসতে ভাসতে এক জেলের জালে আবন্ধ হই। সেই জেলে আমায় তীরে নিয়ে যায় এবং অনেক চেষ্টা করে আমার নিঃশ্বাস ফেরায়। তারপর সে নিয়ে যায় আমাকে তার বাড়িতে। আমি তাকে সব ঘটনার কথা খুলে বলি। জেলে তখন ভীত হয়ে এক দাসী-ব্যবসায়ীর কাছে আমায় বিক্রি করে দেয়। সেই দাসী ব্যবসায়ী আমাকে বিক্রি করে যায় বোগদাদের বেগমের কাছে।

বাদশাহ হারুণ-অল-রশীদ ভালো করে তাকিয়ে দেখলেন দার্দেনির দিকে। সত্য-সত্যই অপূর্ব রূপ মেয়েটির। পৃথিবীতে কোনো মানবীর যে এমন রূপ হতে পারে তা তিনি কল্পনাও করতে পারেননি। এই নারীর দেহটি যেন স্বর্গজ্যোতিঃ দিয়ে গড়া। বাদশাহ এবার দৃষ্টি ফিরিয়ে বেগমকে বললেন—বেগম, তোমার কাছে আমার একটা অনুরোধ আছে। তুমি একে আবুল কাসেমের কাছে ফিরিয়ে দাও।

বেগম জোবেদী বললেন –এর চেয়ে সুখের বিষয় আর কি হতে পারে জাঁহাপনা? দার্দেনিকে আবুল কাসেমের মতো মহাপ্রাণ ব্যক্তির কাছে ফিরিয়ে দিতে আমার কোনো আপত্তি নেই।

এর কয়েক দিন পরে দার্দেনির সঙ্গে আবুল কাসেমের বিবাহ হয়ে গেল বেশ সমারোহ করে। সারা রাজ্য জুড়ে কয়েকদিন ধরে চললো নাচ-গান ও ভোজন উৎসব।

রাজ্যে যখন এইভাবে আনন্দোৎসব চলছে ঠিক সেই সময়ে বসোরার উজিরকে বন্দী করে আনলেন জাফর। সুলতানকে কোথাও পাওয়া গেল না—তিনি কোথায় পলায়ন করেছেন।

বাদশাহ বললেন এই শয়তান উজিরের ষড়যন্ত্রেই আবুল কাসেমের মতো মহৎ ও জ্ঞানী ব্যক্তির জীবন সংশয় দেখা দিয়েছিল। আর এর প্রতি প্রাণদণ্ডের আদেশ দিচ্ছি ।

উজির একথা শুনে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন আবুল কাসেমের দিকে। উপস্থিত সকলেই বললেন হ্যা, প্রাণদণ্ডই এমন শয়তানের উপযুক্ত শাস্তি।

কিন্তু আবুল কাসেম বললেন–অনুতাপের চেয়ে বড় শাস্তি আর কিছু হয় না। জাঁহাপনা, আমার অনুরোধ. উজিরের প্রাণদণ্ড না দিয়ে ওঁকে আপনি রাজ্য থেকে বিতাড়িত করে দিন। তাহলে অনুতাপের আগুনে উনি যথেষ্ট শাস্তি ভোগ করবেন।

আবুল কাসেমের মুখে এ ধরনের কথা শুনে খলিফা বললেন প্রকৃতই আপনি মহৎ আবুল কাসেম। বেশ, আপনার কথামতো উজিরকে রাজ্য থেকে নির্বাসন-দণ্ড দিলাম। উজিরকে সেই মুহূর্তে বোগদাদ থেকে বের করে দেবার জন্য নির্দেশ দিলেন জাফরকে। খলিফা এবার আবুল কাসেমকে বললেন – আমি চাই আপনিই হোন এখন বসোরার সুলতান। আপনি এতে সম্মত কি না বলুন।

আবুল কাসেম বললেন এতে আমার মত নেই জাঁহাপনা। আমার ইচ্ছা, যারা আমার জীবন রক্ষা করেছে অর্থাৎ শাহজাদা আলি ও বালকেশী—তারাই হোক বসোরার সুলতান ও বেগম।

বাদশাহ হারুণ-অল-রশীদ আর অমত করলেন না। তিনি শাহজাদা আলিকেই সুলতানের পদ দান করবেন বলে স্থির করলেন।

রাজ্যসুদ্ধ লোক ধন্য ধন্য করতে লাগলো আবুল কাসেমের নামে। সকলের মুখেই এক কথা— আবুল কাসেমের মতো মহৎ ও উদার ব্যক্তি সত্যই এ পৃথিবীতে বিরল।

এর পর বাদশাহের প্রাসাদে আরও কিছুকাল কাটালেন আবুল কাসেম। তারপর একদিন দার্দেনিকে সঙ্গে নিয়ে তিনি যাত্রা করলেন নিজের বসোরা নগরীতে। বাদশাহ হস্তী, অশ্ব ও প্রচুর ধনরত্নাদি উপহার দিয়েছিলেন আবুল কাসেমকে ৷ সানন্দে সে-সব গ্রহণ করেছিলেন তিনি ।

বসোরায় ফিরে মহানন্দে অতিবাহিত করতে লাগলেন আবুল কাসেম ও দার্দেনি। সুলতান শাহজাদা আলি ও তাঁর বেগম বালকেশীর সঙ্গে তাঁদের হৃদ্যতা অক্ষুণ্ণ রইলো।

ধাত্রী ফতেমা তার গল্প শেষ করে শাজজাদী ফরোখনাজকে জিজ্ঞাসা করলে— গল্প কেমন লাগলো শাহজাদী ?

শাহজাদী বললেন এটা আবার একটা গল্প হলো নাকি? আবুল কাসেম দার্দেনিকে ভালবেসেছিল। তার ভালবাসা ছিল মেকি, তা না হলে সে আবার বালকেশীকে বিবাহ করার কথা মুখে আনে কি করে? অবশ্য দোষ তার একার নয়, পৃথিবীর সব পুরুষই এমনি স্বার্থপর।

ধাত্রী বলল— বেশ, তাহলে আর এক পুরুষের কাহিনী তোমাদের

শোনাচ্ছি। শাহজাদীর সহচরীরা বলল–হ্যা হ্যঁা, বলো ধাইমা। শাহজাদী বললেন কোনো আদর্শ পুরুষের কাহিনী জানা থাকে তো

বলো। তাহলে আমি শুনতে রাজী আছি। ধাত্রী ফতেমা এবার রাজা রাজবনশাহের কাহিনী বলতে শুরু করলো। শাহজাদী স্থির হয়ে বসে শুনতে লাগলেন। শাহজাদীর সহচরীরাও রুদ্ধনিঃশ্বাসে গিলতে লাগলে ধাত্রী ফতেমার গল্প।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ