হিরামন তােতার কাহিনী । ঠাকুমার ঝুলি গল্প । মজার মজার রুপকথার গল্প পর্ব ১

 হিরামন তােতার কাহিনী

একদিন এক শিকারি শিকারের জন্য গভীর এক জঙ্গলে গেল। সেখানে ঘুরতে ঘুরতে একটি গাছের ডালে সুন্দর হিরামন তােতা পাখি দেখতে পেল, আর সঙ্গে সঙ্গে শিকারি কাঁধ থেকে তীর-ধনুক নামিয়ে হিরামন। তােতার দিকে তাক করল। হিরামন তােতা গাছের ডালে বসে শিকারিকে অনেকক্ষণ ধরে লক্ষ করছিল। সে তখন মানুষের ভাষায় কাতর স্বরে বলল, ওহে শিকারি, আমাকে মেরে ফেলে তােমার কী লাভ? বড়জোর রান্না করে কয়েক টুকরাে মাংস খেতে পারবে, তার চেয়ে বরং আমাকে এরাজ্যের রাজার কাছে বিক্রি করে দাও, দেখবে তুমি অনেক টাকা পাবে।

শিকারি হিরামন তােতা পাখির কথা শুনে তাচ্ছিল্য ভরে বলল, “তােমাকে রাজার কাছে বিক্রি করলে কত আর টাকা পাওয়া যাবে? 

তােতা পাখি বলল, তুমি আমার কথা একবার বিশ্বাস করে দেখতে

শিক্ষনীয় মজার গল্প, সেরা রূপকথার গল্প, গোপাল ভাঁড়ের গল্প, পুরানো মজার গল্প, গল্প গল্প, রূপকথার রাজকন্যার গল্প, ভালো গল্প, শিয়ালের গল্প,

পারাে। আমার দামের কথা আমি নিজেই না হয় রাজাকে বলব, তােমাকে কোনও কথা বলতে হবে না।

শিকারি এক মুহূর্ত চিন্তা করে বলল, “ঠিক আছে, তােমার কথামতােই। না হয় সবকিছু হবে। দেখি মূল্য কতটা পাই!
একসময় শিকারি হিরামন তােতাকে নিয়ে রাজদরবারে উপস্থিত হল। মহারাজ পাত্রমিত্র সহ রাজদরবারে বসে ছিলেন। শিকারির হাতে সুন্দর হিরামন পাখি দেখে তিনি সভাসদদের উদ্দেশে বললেন, ‘ভারী সুন্দর পাখি তো

রাজদরবারে উপস্থিত সকল সভাসদ মহারাজের কথায় সম্মতি জানিয়ে বলল, “ঠিক বলেছেন মহারাজ।

শিকারি মহারাজের সামনে এসে অভিবাদন জানিয়ে বললেন, মহারাজ, আমি এই পাখিটা আপনার কাছে বিক্রি করতে চাই।' | মহারাজ খুশি হয়ে বললেন, ‘তা তোমায় এই পাখির জন্য কত দিতে হবে শুনি?
শিকারি বলল, “মহারাজ, পাখির দাম পাখি আপনাকে নিজের মুখেই বলবে। আপনি অনুগ্রহ করে পাখির কাছেই সেটা জিজ্ঞেস করুন।
মহারাজ শিকারির কথা শুনে অবাক হয়ে গেলেন। মনে মনে ভাবলেন, লােকটি নিশ্চয়ই পাগল। তাই রেগে গিয়ে বললেন, 'আমার সঙ্গে মশকরা হচ্ছে? পাখি কথা বলতে পারে! এই কে আছাে, এই উম্মাদকে গলাধাক্কা দিয়ে রাজদরবার থেকে বের করে দাও তাে।  
শিকারি হাতজোড় করে অনুরােধের সুরে বলল, অপরাধ ক্ষমা করবেন। মহারাজ, অনুগ্রহ করে এই গরিবের কথা একবার বিশ্বাস করে দেখুন না!
মহারাজ বললেন, ঠিক আছে, তা হিরামন বলাে দেখি তােমার দাম কত?”
হিরামন তােতা পা তুলে প্রথমে মহারাজকে প্রনাম জানিয়ে বলল, মহারাজ আমার মূল্য এক সহস্র স্বর্ণমুদ্রা।
তােতার মুখে মানুষের কণ্ঠস্বর শুনে মহারাজ চমকে উঠলেন, মনে মনে ভাবলেন, শিকারি তাে মিথ্যা বলেনি। টাকার অঙ্কটা শুনে মহারাজ আবার বললেন, ‘এত টাকা দিয়ে তােমাকে নিয়ে আমার লাভ?
মহারাজ, লাভ-লােকসানের ব্যাপারটা তাে এখনই কিছু বুঝতে পারবেন না।'

মহারাজ অবশেষে শিকারিকে এক সহস্র স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে বিদায় দিলেন ।
মহারাজের নির্দেশে হিরামন তোতার জন্য একটা সােনার খাঁচা তৈরি করা হল। সােনার খাঁচাটি মহারাজের সিংহাসনের পাশে রাখা হল । দিনে দিনে মহারাজ পাখিটিকে যত দেখছেন ততই যেন মুগ্ধ হচ্ছেন। 
হিরামন তোতা যে শুধু দেখতেই সুন্দর তা নয়, গুণও আছে অনেক। মহারাজের যখন মন খারাপ লাগত তখন হিরামন সুন্দর সুন্দর গান গেয়ে মহারাজকে শােনাত। তাতে মহারাজের মন খুশিতে ভরে উঠত। আবার তোতা পাখি অনেক সময় শাস্ত্রের কথা বলত, নানারকম উপদেশ দিত। মহারাজ ভেবে দেখলেন যে, খুবই কম দামে তিনি এই দুপ্রাপ্য পাখিটা কিনেছেন।

এই রাজার ছিল ছয় রানি, রানিদের মনে কোনও সুখ ছিল না। থাকবেই বা কী করে? এত বছর পার হয়ে গেল অথচ কোনও রানি সন্তানের মা হতে পারেননি।

এদিকে সারাদিনই হিরামন তােতাকে নিয়ে রাজার সময় ভালই কেটে যায়। রানিদের মনে হিংসা, এই তােতা পাখিই রাজার সর্বনাশ ডেকে আনছে। একে যে করেই হােক তাড়াতে হবে, না হলে শান্তি আসবে না। মনে মনে ছয় রানি ফন্দি আঁটতে লাগলেন।  

একসময় রানিদের সুযােগও এসে গেল। পাত্রমিত্রদের নিয়ে শিকারে বেরিয়েছিলেন মহারাজ। পাঁচ-ছয়দিন জঙ্গলে কেটে যাবে। তারপর শিকার শেষ করে মহারাজ ফিরবেন। 

এই সুযােগ রানিরা কেউ হাতছাড়া করতে চাইলেন না। যুক্তি করে ছয় রানি হিরামন তােতার খাচার কাছে গেলেন। হিরামন তােতা ছয় রানিকে একসঙ্গে দেখে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের গুণকীর্তন করতে লাগল। 
রানিরা পাখির মুখে ভগবানের নাম শুনে বিভাের হয়ে পড়লেন এবং হিরামন পাখিকে মারার কথা বেমালুম ভুলে গেলেন। সেদিন আর হিরামনকে তাঁরা তাড়াতে পারলেন না। 
পরদিন ঠিক করলেন। হিরামনকে যে করেই হােক তারা তাড়াবেন। মনে মনে ঠিক করলেন আজ আর হিরামনের মধুর স্বর শুনে, কিছুতেই স্থির লক্ষ্য থেকে তাঁরা দূরে সরে যাবেন না।

ছয় রানি যথাসময়ে উপস্থিত হলেন হিরামনের সােনার খাঁচার সামনে। হিরামন ভগবানের নামগান শুরু করার আগেই হঠাৎ এক রানি বলে বসলেন, 

আচ্ছা হিরামন, মহারাজ তাে তােমার প্রশংসায় পঞ্চমুখ । বলেন-তােমার মতাে বুদ্ধিমান আর একটিও নেই! তা বলােত হিরামন আমাদের ছয় রানির মধ্যে কে বেশি সুন্দরী আর কে বেশি কুৎসিত?

বুদ্ধিমান হিরামন রানিদের ফন্দি বুঝতে পেরে বলল, এই খাঁচার ভেতর থেকে তােমাদের দেখে কী বলি বলাে তাে? 

খাচায় থেকে তােমাদের মুখ যে ভাল করে দেখতে পাচ্ছি না। এক কাজ করাে, খাঁচার মুখটা খুলে দাও, 

আমি বাইরে বেরিয়ে তােমাদের ভালভাবে দেখে, বলে দেব কে বেশি সুন্দরী আর কে বেশি কুৎসিত।'

ছয় রানি হিরামনকে মারার আগে একটু মজা করার জন্য বললেন। ঠিক আছে হিরামন তাই হবে, এই বলে ছয় রানি ঘরের সমস্ত জানলা বন্ধ করে দিয়ে খাঁচার দরজা খুলে দিলেন। 

হিরামন খাচার বাইরে বেরিয়ে দেওয়ালের মাথায় ছােট্ট ঘুলঘুলিটা দেখে মনে মনে আশ্বস্ত হয়ে ভাবল, দরজা জানলা বন্ধ করলে কী হবে? আমি আমার পালাবার পথ ঠিক পেয়ে গেছি।  

হিরামন বাইরে বেরিয়ে এলে রানিরা বললেন, এবার বলাে তাে হিরামন আমাদের মধ্যে কে বেশি সুন্দরী? আর কে কুৎসিত?

হিরামন হিঃ হিঃ করে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল, “ওগাে ছয় রানি, গর্ব করার মতাে তােমাদের কারও সেই রূপ নেই। মহারাজ তােমাদের অনুগ্রহ করে গ্রহণ করেছেন। রূপ যদি দেখতে হয় চলে যাও সাত সমুদ্র তেরাে নদী পেরিয়ে সেই রাজ্যে, সেই রাজকন্যার রূপের সুখ্যাতি কে না জানে, তােমরা তার পায়ের যােগ্য নও।' 

তবে রে’ বলে ছয় রানি যেই হিরামনকে মারতে গেলেন, হিরামন। অমনই ফুড়ত করে সেই ঘুলঘুলি দিয়ে পালিয়ে নীল আকাশে উড়ে গেল।

মহারাজ শিকার-শেষে ফিরে হিরামনকে দেখতে না পেয়ে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন। কোথায় গেল তার হিরামন? চিৎকার করে চাকরবাকরদের ধরে আনবার আদেশ দিলেন। কিন্তু তারা জানবেই বা কী করে? রাজার হুঙ্কারে তারা ঠকঠক করে কাপতে পাকতে বলল, “মহারাজ, আমরা কী করে জানব হিরামনের খবর! আমরা ভুলেও কখনও আপনার অন্দরে প্রবেশ করিনি।

তিনি ডেকে পাঠালেন রানিদের, তাঁরা হিরামন নেই শুনে আকাশ থেকে পড়লেন, মরাকান্না জুজে দিলেন। মহারাজ হিরামনের বিরহে মনমরা হয়ে পড়লেন। 

সর্বক্ষণ গালে হাত দিয়ে হিমরামনের কথা ভাবতে লাগলেন। রাজ্য-রাজকার্য এমনকী নিজের খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে পর্যন্ত উদাসীন হয়ে পড়লেন।

মন্ত্রীদের মাথায় হাত পড়ে গেল। মহারাজ এমন উদাসীন হয়ে পড়লে রাজকার্য দেখাশােনা করবেন কে?

শেষ পর্যন্ত মন্ত্রীরা আলােচনা করে ঢােল পিটিয়ে রাজ্যের সর্বত্র জানিয়ে দিল- যে ব্যক্তি মহারাজের হিরামন তােতা ফিরিয়ে দিতে পারবে তাকে পাঁচশত স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে পুরস্কৃত করা হবে।

এদিকে হিরামন তােতা মন্ত্রীদের ঘােষণার কথা একসময় জানতে পারল। রাজপ্রাসাদের নিকটে এক কাঠুরের কুঁড়েঘর ছিল। সে সারাদিন কাঠ কেটে অতি কষ্টে দু'বেলা দু'মুঠো খেতে পাচ্ছিল।

হিরামন তােতা একদিন কাঠুরের কুঁড়েঘরের সামনে গিয়ে বলল, ‘ও কাঠুরে ভাই, আমি মহারাজের হিরামন তােতা পাখি। তুমি কি পুরস্কারের ঘােষণা শুনেছ? আমাকে মহারাজের কাছে পৌছে দিলে পাঁচশত স্বর্ণমুদ্রা উপহার পাবে । 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ